ঢাকার পতিত নগর পরিসরে সহসা রাজধানী জেগে ওঠায় আবাসন ও নির্মাণ খাত হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। সেই বাতাবরণে জহুরুল ইসলামের সৃজনী পদক্ষেপ ছিল তুরুপের তাস। ক্ষুদ্র ঠিকাদারি দিয়ে শুরু। দেশের সীমানা মাড়িয়ে বিদেশ-বিভুঁইয়ে তিনি গড়েছেন আকাশচুম্বী অট্টালিকা, সড়ক-মহাসড়ক, কল-কারখানা; এমনকি দেশের আঙিনায় বুলন্দ করেছেন বিদেশি বড়-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক ও শৌখিন গাড়ির সমৃদ্ধি। রাজধানী ঢাকার নির্মাণ, আবাসন ও বিস্তৃতির বিবর্তনিক ইতিহাসের ধারাক্রমে জহুরুল ইসলাম তাই এক অবিচ্ছেদ্য প্রাসঙ্গিকতা। পর্ব-১১
মিজানুর রহমান শেলী: উনিশ বা বিশ শতকের প্রথমার্ধ। এই সময় ফ্রেমে ঢাকার সাধারণ জীবন মানের চিত্র যেন বিচিত্র। ঘন জঙ্গল আর দারিদ্র্যে চাপা জীবনের মাঝেও কোথাও কোথাও আভিজাত্য চাহর হতো। বি.সি এলিয়েনের ১৯১২ সালে ঢাকার বর্ণনায় তা পাওয়া যায়।
তখন ঢাকায় প্রচুর ইট নির্মিত বাড়ি ছিল। এর বেশিরভাগই নদীতীরে। আকারের দিক দিয়ে ভিন্নতা ছিল। বাড়িগুলোতে ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতি খুব কমই চোখে পড়ত। আয়েশ আর আভিজাত্য মুখ্য ছিল না। এ বাড়িগুলোতে বহু সংখ্যক ঘর থাকত। ঘরগুলো খুব ছোট ও অন্ধকার কুঠরির মতো হতো। এলিয়েনের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, এই বাড়িগুলো দরিদ্র নয়; তবে সচ্ছল অর্থসম্পন্ন মানুষের।
অন্যদিকে কিছু কিছু রাজমিস্ত্রির হাতে গড়া উন্নত ইটের দালানও চোখে পড়ত। এগুলোর অভ্যন্তরীণ নকশা ছিল উন্নত। বিশেষ করে জেলার দক্ষিণের বাড়িগুলোতেই এই আভিজাত্য চোখে পড়ত। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার ছিল যারা তাদের পৈতৃক পুরুষ থেকে বাড়িগুলো ব্যবহার করে আসছিল। এলিয়েনের এ বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, ব্রিটিশ আমলের এই বাড়িগুলোর বেশিরভাগই ছিল মোগল আমলের কিংবা কোম্পানি আমলের। এটা বলতে বাধা নেই, এই বাড়িগুলোকে স্থানীয় দৃষ্টিতে বড় লোক বা ধনীদের বাড়ি বলে বিবেচনা করতে হতো। আদতে তা ছিল সচ্ছল বা মধ্যবিত্ত পরিবারের।
দরিদ্রদের বাড়ির বর্ণনাও এলিয়েন উল্লেখ করেন। ঢাকায় সে সময়ে গরিব শ্রেণির মানুষের বাড়িতে সাধারণত মাটির দেয়াল থাকত। ছাদে ব্যবহার করা হতো কেরোসিন তেলের টিন। এই টিন প্রথমে পিটিয়ে সমান করা হতো। তারপর বাঁশের আড়ার ওপর টেনে লাগিয়ে দেওয়া হতো। আবার কিছু বাড়ির দেয়ালে বাঁশের কাবারি ব্যবহার করা হতো। সেক্ষেত্রে ছাদ হতো খড় কিংবা তালপাতার ছাউনি।
কিষানদের বাড়িগুলোর অভ্যন্তরভাগে থাকত বাঁশের কাবারি বা চটা অথবা নলখাগড়ার বেড়ার ওপর মাটির প্রলেপ। ছাদে থাকত খর, কাশ বা তালপাতার ছাউনি। আবার কখনও কখনও ঢেউখেলানো লোহা দেখা যেত। এ ধরনের ঘরের ছানির কেন্দ্র দুই পাশের প্রান্তের চেয়ে অনেক উঁচু হয়। তাই দেখতে বাঁকানো ছাদের মতো দেখায়। তাতে ঝড়ে চাল ভাঙার সম্ভাবনাও কমে যায়। বন্যাপ্রবণ এলাকাতে উঁচু ঢিবির ওপর ঘর তুলত তারা। এমনকি খরচসাশ্রয়ী করার জন্য তারা ছোট ও অস্বচ্ছন্দ ঘর তুলত। ঢাকার উত্তরাঞ্চলের ঘরগুলো দক্ষিণের তুলনায় কম প্রশংসাই পাবে। তাদের বাড়ির মেঝে ছিল নিচু। কৃষকরা তাদের বাড়ির ভিটাকে একটি নির্দিষ্ট সমতলে প্রস্তুত রাখার চেষ্টা করতেন। এমনকি প্রতিটি ভিটার ওপরে তিন বা চারটি বাড়ি দেখা যেত। আর প্রতিটি বাড়িকে ঘিরেই একটি আঙিনা থাকত। এই আঙিনা নিয়মিত মাটি ও গোবর দিয়ে লেপে দেওয়া হতো। এই লেপন লাগানো আঙিনাকে তার যতœ করে রাখত। কেননা পশু বা মানুষের চলাফেরা বা অন্য কোনো কর্মকাণ্ডে বা খোঁড়াখুঁড়ি ও আচরা-আচরিতে এই মাটির আঙিনা সহজেই ছোট ছোট আঁচড় বা বিচ্ছিন্ন গর্তে কাজের অনুপযোগী হয়ে যেত। তবে সব সময় ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার রাখা হতো।
কিছু নির্দিষ্ট গ্রামে দেয়াল তৈরির উপযোগী মাটি পাওয়া যেত। সে গ্রামের লোকেরা কাদা দিয়ে ঘরের দেয়াল বানাত। আবার পাকা দালানেও এই মাটির ব্যবহার ছিল। অবশ্য সম্পদশালী সাহাদের বাড়িতেই কেবল মাটির গাঁথুনিতে ইটের দালান থাকত। যাহোক, বাড়িগুলো দেখতে হতো চমৎকার। এই মাটির স্থাপত্যেও সবচেয়ে ভালো উদাহরণ ছিল মুড়াপাড়া, সাভার, বিরুলিয়া, ধামরাই, ভাবলা, গোতাসিয়া ও মোনোহার্দিতে।
যাহোক, মেঝেসহ ঢাকার উত্তরের অঞ্চলের বন্যাপ্রবণ এলাকায় কৃষকদের কুঁড়েঘর বানাতে খরচ হতো ৪০০ রুপি। আর তিন-চারটি বাড়ির জন্য ভালো ভিটামাটি গড়তে খরচ হতো ১০০ রুপি। আর মুড়াপাড়ার মতো মাটির বাড়ি বানাতে খরচ হতো ৩০০ রুপি।
আসবাবপত্র বলতে ছিল গৃহপণ্য। এগুলো দরিদ্র বা ধনী সবারই ছিল তুলনামূলকভাবে কম আকর্ষণীয়। এমনকি সম্পদশালী জমিদাররাও ঘরের মধ্যে থাকত অল্প-স্বল্প আসবাবপত্র; যা থাকত তা কেবল নিজের ব্যবহারের জন্যই। আবার এসব আসবাবের প্রয়োজনীয়তাও ছিল সীমিত। একটি কাঠের পাটাতন বা তক্তাপস থাকত। আর থাকত একটি শতরঞ্জি। আর কিছু বড় দেয়ালের ওপর সম্মানিত মেহমানরা বসত। তবে কম সম্মানীয় লোকদের জন্য থাকত নিচু বেঞ্চ বা মাদুর। তবে ধনীদের বাড়িতে মেহমানের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ ইউরোপীয় রীতির ঘর থাকত। তবে তা কেবল ইউরোপীয় অতিথিদের অভ্যর্থনার জন্য।
কৃষকদের সময় সব সময় ছিল খুব সাদামাটা। একটি অথবা দুটি বাক্সতে তারা তাদের পোশাক-পরিচ্ছেদ সংরক্ষণ করত। একটি কাঠের টুল থাকত। আর থাকত কিছু মাদুর। এই মাদুর তারা মাটির মেঝেয় পেতে ঘুমাত। এসবই ছিল তাদের আবাসন সুখ।
সাধারণ গ্রামবাসীরা জোড়াতালি দেওয়া তোশক ব্যবহার করতেন। এগুলো তুলায় তৈরি হতো। সামান্য কিছু দিন ব্যবহারের পরই তার পুরোনো হয়ে যেত। আর সচ্ছল লোকরা চাদর ও তুলায় তৈরি লেপ ব্যবহার করত শীতকালে। তবে সব শ্রেণির লোকেরাই মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে মশারি ব্যবহার করত। এই মশারিগুলো এখনকার মশারির মতো নয়। ওগুলো ছিল মোটা ও গুমোট কাপড়ে বোনানো মশারি। ত্রিপুরা ও নোয়াখালী থেকে এগুলো আসত। তবে ল্যাঙ্কশায়ারের কাপর আসার পর ইউরোপীয় মেশিনে বোনা পাতলা মশারির চল শুরু হয়েছিল। এগুলো ব্যবহার করত উচ্চ শ্রেণির লোকরা। উল্লেখ্য, স্বদেশি আন্দোলনের সময় উচ্চ শ্রেণির লোকরাও ওই ত্রিপুরা বা নোয়াখালীর তৈরি মোটা কাপড়ে বোনানো মোটা ও গুমোট মশারি ব্যবহার শুরু করে।
খাওয়া ও রান্নার কাজে তারা পিতল ও বেল-মেটালে তৈরি পাত্র ও কড়াই ব্যবহার করত। সেই সঙ্গে কলাই করা লোহার তৈরি থালা ও গামলা ব্যবহার করত। সস্তা দামের হাতে বানানো খুব সাধারণ মানের মাটির তৈজসও তারা ব্যবহার করত। পিতলের চেয়ে কলাইকরা পাত্র ছিল সস্তা ও পরিষ্কার করাও ছিল সহজ। কিন্তু তাও স্বদেশি আন্দোলনের কালে বর্জন করা হয়। কৃষকরা বাতি ব্যবহার করত। এগুলো ছোট টিনের কৌটা সদৃশÑতার মধ্যে কেরোসিন থাকত। আবার অনেকে মাটির তৈরি অখণ্ড পিরিচে তেলের মধ্যে ভাসমান পাতলা সুতা দিয়ে বাতি জ্বালাত। কিন্তু শীতের দিনে কৃষকরা খুব সন্ধ্যা ঘন হতেই বিছানায় যেত। এসব রাতে তারা কেবল চুলার আগুনেই সন্তুষ্ট থাকত।
এই নিদাঘ কষ্টের জীবনালেখ্য আজকের ঢাকার যাপিত জীবনের সঙ্গে মিলবে না। এই ঢাকায় আজ আকাশচুম্বী অট্টালিকায় নি¤œ থেকে নি¤œ-মধ্যবিত্তরাও ঠাঁই পাচ্ছে। তার পেছনে আবাসনশিল্পের পুরোধা ব্যক্তি জহুরুল ইসলামের নাম বিজড়িত হয়। কিন্তু ঢাকার এই উঁচু উঁচু অট্টালিকার আলিশান প্রাসাদে ঢাকাবাসীর জীবনে খুব বেশি শান্তির ঘুম পরশ বুলায় না। উপর্যুপরি উন্নয়ন আর অপরিকল্পিত অসার স্বপ্নের অবগাহনে ঢাকা হয়েছে বিশ্বের কয়েকটি বাস অযোগ্য শহরের অন্যতম। এখানকার স্বাস্থ্যকর পানির অভাব, যান চলাচলে সংকট, বিদ্যুতে বিভ্রাট, পরিবেশ দূষণসহ নানা ধরনের দুর্নীতি নিত্যদিনের ব্যর্থতার কাহিনী। এই ঢাকা নিয়ে জহুরুল ইসলামদের সেই গৃহায়ন স্বপ্ন কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে সে প্রশ্ন এসে যায়। আবার গৃহায়নের পাশাপাশি সার্বিক অবকাঠামো বিচারে আবাসনশিল্পের বাণিজ্যিকীকরণ কতটুকু যুক্তিসঙ্গতÑসে প্রশ্নও এই গবেষণায় উঠে এসেছে। তবে জহুরুল ইসলামদের সে সময়ের আবাসন প্রকল্প আজকের ঢাকার উন্নয়নের চাকায় গতি এনেছিলÑসে বিষয়ে কোনো সংশয় নেই।
লেখক: গবেষক, শেয়ার বিজ।