শাহরিয়ার কামাল: আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে একটি কথা বলতে চাই, আবাসন খাতের ব্যবসা একটি দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক অর্থনীতিবিদ এই খাতকে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিনও বলে থাকেন। কারণ, আবাসনে বিনিয়োগ হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২৬৯টি উপখাত বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়। মাঝে আমাদের আবাসন খাতে একটা মন্দাভাব গেছে। তার একটি বড় কারণ হচ্ছে, মন্দার আগে ফ্ল্যাটের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছিল। তাই একটা পর্যায়ে এসে ধস নামে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে খাতটি স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। ব্যবসা ধীরে ধীরে বাড়ছে। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যখন ব্যবসা ধীরে ধীরে বাড়ে তখন সেটি স্থায়ী হয়। বেশ কয়েক বছর ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭-৮ শতাংশ হচ্ছে। সরকারও আবাসন খাতকে চাঙা করতে বেশ কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যাংকঋণের সুদের হার কমিয়ে আনার চেষ্টার পাশাপাশি গৃহঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারীরা ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ২০ বছরের জন্য রেয়াতি সুদে ঋণ নিতে পারছেন। অন্যদিকে বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে ক্রেতাদেরও আস্থা বেড়েছে। এই আস্থার বিষয়টি আবাসন খাতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ক্রেতাদের আস্থা থাকলে খাতটি ভালো করবে। আর আস্থা না থাকলে খারাপ করবে, তখন মানুষের কাছে পয়সা থাকলেও তারা বিনিয়োগ করবে না। সবকিছু মিলিয়ে আমরা দেখছি, আবাসনের চাহিদা বাড়ছে। তবে আগের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চাহিদা বাড়ছে না। তাতে দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বিষয়টি ক্রেতাদের জন্যও ভালো।
প্রথম আলো: আপনাদের কাছ থেকে সমাজের কোন ধরনের মানুষ ফ্ল্যাট বেশি কেনেন। পেশাজীবী নাকি ব্যবসায়ী?
শাহরিয়ার কামাল: আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রকল্পগুলোতে তুলনামূলক কম দামের ৫০০ বর্গফুট থেকে শুরু করে ১০ হাজার বর্গফুটের অভিজাত ফ্ল্যাট আছে। আবার ১০০ বর্গফুটের দোকান থেকে শুরু করে ১৫ হাজার বর্গফুটের অফিস স্পেসও আছে। তার মানে আমরা সমাজের সব ধরনের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী ফ্ল্যাট বা বাণিজ্যিক স্পেস নির্মাণ ও বিক্রি করছি। ফলে পেশাজীবী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, করপোরেট, বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মরত মানুষজন আমাদের গ্রাহক। তাদের মধ্যে পেশাজীবীর সংখ্যা বেশি।
প্রথম আলো: বর্তমানে ফ্ল্যাটের দাম আকাশছোঁয়া। আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো মধ্য আয়ের মানুষজনকে সাধ্যের মধ্যে ফ্ল্যাট দিতে পারছে না কেন?
শাহরিয়ার কামাল: মধ্য আয়ের মানুষের মধ্যেই আবাসনের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বিক্রিও সেখানে বেশি। তবে আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো মধ্য আয়ের মানুষের চাহিদা মেটাতে পারছে না। তাদের কাঙ্ক্ষিত দামেও দিতে পারছি না। কারণ হচ্ছে, ঢাকার মধ্যে জমির দাম অত্যধিক বেশি। চাহিদা ও জোগানের মধ্যে বিরাট ফারাক থাকার কারণেই জমির দাম বেশি। অন্যদিকে ঢাকার বাইরেও জমির দাম বেড়ে গেছে। তবে যে জায়গার দাম তুলনামূলক কম সেখানে ফ্ল্যাটের প্রকল্প করে ক্রেতাদের নিতে পারছি না। কারণ, সেখানকার যোগাযোগব্যবস্থা ও নাগরিক সুবিধাদি অপ্রতুল রয়েছে। বিদেশে আপনি দেখবেন, বড় শহরকে কেন্দ্র করে ছোট ছোট স্যাটেলাইট সিটি গড়ে উঠেছে। সেখানে যাতায়াতের জন্য গণপরিবহন রয়েছে। ফলে লোকজন শহরের বাইরে থেকে অল্প সময়ে এসে চাকরি বা ব্যবসা করে ফিরে যেতে পারে। এ রকম ব্যবস্থা করা গেলে ফ্ল্যাটের দাম মধ্য আয়ের মানুষের সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসতে পারব।
প্রথম আলো: এই কথাগুলো আপনারা ব্যবসায়ীরা তো দীর্ঘদিন ধরে বলার চেষ্টা করছেন। সমাধান আসছে না কেন?
শাহরিয়ার কামাল: আমি প্রশ্নটির উত্তর দুইভাবে দিতে চাই। আমরা ১৫-২০ বছর আগে ঢাকার ভেতরে লেকসিটি কনকর্ড নামে একটি স্যাটেলাইট টাউনশিপ প্রকল্প করেছি। সেখানে আড়াই হাজার ফ্ল্যাট আছে। ইতিমধ্যে প্রায় দুই হাজার অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়েছে। প্রকল্পটিতে ৮-১০ হাজার লোক থাকছে। তাদের জন্য প্রকল্প এলাকায় স্কুল, মসজিদ, শপিং সেন্টারসহ নানা সুযোগ-সুবিধা আছে। তবে হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি এই ধরনের প্রকল্প করতে পারবে। কারণ, এ ধরনের প্রকল্পে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করতে হয়। আমরা মনে করি, এই জায়গাতে রাজউক ও বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার সুযোগ আছে। জমি অধিগ্রহণ করে যদি সরকার দরপত্রের মাধ্যমে আবাসন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সাশ্রয়ী মূল্যে বিতরণ করে তাহলে কম দামে ফ্ল্যাট দেওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে সরকার ফ্ল্যাটের সর্বোচ্চ দাম বেঁধে দিতে পারে। পাশাপাশি সরকারকে গণপরিবহনসহ অন্যান্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে যাতে মানুষজন সেখানে যেতে আগ্রহী হয়। বর্তমানে মধ্য আয়ের মানুষের জন্য আমার কাছে শ্রেষ্ঠ উপায় মনে হয়, সরকার–বেসরকারি অংশীদারত্বে প্রকল্প গ্রহণ করা।
প্রথম আলো: আপনি যে সমাধানের কথা বললেন সেটি তো রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পেও করা সম্ভব। আপনার মতামত কী?
শাহরিয়ার কামাল: পূর্বাচল সরকারের খুব ভালো উদ্যোগ। তবে প্রকল্পটি আরও আগে করলে মূল ঢাকাকেন্দ্রিক আবাসনটি কমে আসত। বর্তমানে পূর্বাচলের জমির দাম অনেক বেড়ে গেছে। তাই সেখানে বেসরকারি আবাসন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে বড় জমি কিনে প্রকল্প করা খুব কঠিন। একটি প্রকল্পের মূল খরচই বর্তমানে জমির ওপর নির্ভর করে।
প্রথম আলো: রাজউক যে দামে সাধারণ মানুষকে প্লট দিয়েছে সেই দামে পেলে কি সাশ্রয়ী মূল্যে ফ্ল্যাট দেওয়া সম্ভব?
শাহরিয়ার কামাল: অবশ্যই সম্ভব।
প্রথম আলো: রাজউকের এমন পরিকল্পনা আছে বলে আমাদের জানা নেই। বরং সংস্থাটি নিজেরাই ফ্ল্যাট প্রকল্প করছে। এটিকে আপনারা কীভাবে দেখেন?
শাহরিয়ার কামাল: রাজউক নিয়ন্ত্রক সংস্থা। রাজউক যদি আবাসন ব্যবসায় নামে তাহলে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা কে নেবে? এটি আমার প্রশ্ন। সাধারণ মানুষের আবাসন সমস্যা সমাধানে রাজউককে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। তারা যেটি করতে পারে সরকারের পরিত্যক্ত জমি বা অধিগ্রহণ করা জমি উন্নয়ন করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিতে পারে। সেটি অবশ্যই ন্যায্য মূল্যে। সে ক্ষেত্রে তারা যেটি করতে পারে ফ্ল্যাটের দামও বেঁধে দিতে পারে।
প্রথম আলো: বাংলাদেশ ব্যাংক গৃহঋণের সীমা বৃদ্ধি করেছে। তবে সুদের হার অনেক বেশি। সেই সুদহারে কি সাধারণ মানুষের পক্ষে ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব?
শাহরিয়ার কামাল: ব্যাংকঋণের সুদের হার বেশি, এটি একমাত্র সমস্যা না। ঢাকা শহরের ভেতরে ফ্ল্যাটের দাম অনেক বেশি। ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন প্রতিবেশী যেকোনো দেশের তুলনায় ব্যয়বহুল। ব্যাংকঋণের সুদের হার দুই অঙ্কের ঘরে। আবার ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদি অর্থাৎ ২০-২৫ বছরের জন্য ঋণ দিতে চায় না। বেশির ভাগ ব্যাংক গ্রাহকদের একটি ভাসমান সুদ হারের প্রস্তাব দেয়। তাতে কোনো কারণে সুদের হার বেড়ে গেলে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের পক্ষে ঋণের কিস্তি দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। প্রতিবন্ধকতা দূর করতে এই বিষয়গুলোতে নজর দেওয়া দরকার।
প্রথম আলো: কনকর্ডের বয়স বাংলাদেশের বয়সের কাছাকাছি। বর্তমানে কনকর্ড কী ধরনের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে?
শাহরিয়ার কামাল: ৪৫ বছরের বেশি সময় ধরে কনকর্ড ব্যবসা করছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ঢাকা, চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিধ্বস্ত সেতু সংস্কার দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। আমাদের সৌভাগ্য, দেশের বেশ কিছু জাতীয় গর্বের স্থাপনা আমরা নির্মাণ করেছি। আমাদের বিজনেস স্ট্র্যাটেজি হলো—একটি জায়গায় যেন বেশি নির্ভরশীল না হয়ে যাই। সে জন্য আমরা অভিজাত ফ্ল্যাট, বাণিজ্যিক স্পেসের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য কয়েকটি প্রকল্প নিয়েছি। আবার স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যেও কিছু প্রকল্প করছি। লেকসিটি কনকর্ডের মতো আরও দুই প্রকল্প করার চিন্তাভাবনা আমাদের মধ্যে রয়েছে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: শুভংকর কর্মকার