দেশের আবাসন ব্যবসায় মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। বিক্রি কমার পাশাপাশি নতুন প্রকল্পেও দেখা দিয়েছে খরা। বিক্রি না হওয়ায় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে পথে বসার আশঙ্কায় রয়েছেন ব্যবসায়ীদের। জানা গেছে, বিক্রি কমে যাওয়ার পাশাপাশি বেড়েছে সব ধরনের ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের দাম, ফলে আরও কমে গেছে চাহিদা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, লোকেশন, চাহিদা আর কোম্পানিভেদে ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্টের দাম বেড়েছে প্রতি স্কয়ার ফিটে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব সূত্র জানায়, দু-তিন বছর আগে গুলশান এলাকায় প্রতি স্কয়ার ফিট ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা ছিল। সেটি বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ২৬ থেকে ৩৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। বনানী এলাকায় বর্তমানে ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে রয়েছে, যা বিগত আড়াই থেকে তিন বছর আগেও বিক্রি হয়েছে ১৬ থেকে ২০ হাজার টাকায়। ধানমন্ডি এলাকায় প্রতি স্কয়ার ফিটে দাম বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ১৭ থেকে ২৫ হাজার টাকার মধ্যে, যা আড়াই থেকে তিন বছর আগে বিক্রি হয়েছে ১২ থেকে ১৮ হাজার টাকার মধ্যে। এছাড়া মিরপুর এলাকায় প্রতি স্কয়ার ফিট বিক্রি হচ্ছে ৬ থেকে ৯ হাজার টাকার মধ্যে। এর আগে যেটা বিক্রি হয়েছে ৪ থেকে ৫ হাজার বা ক্ষেত্রবিশেষে সাড়ে পাঁচ হাজারের মধ্যে। বনশ্রী-আফতাবনগর এলাকায় বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা প্রতি স্কয়ার ফিট। আড়াই থেকে তিন বছর আগেও যেটা বিক্রি হয়েছে সাড়ে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকার মধ্যে। উত্তরা (সেক্টর ১-৭) প্রতি স্কয়ার ফিট বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৮ থেকে ১৩ হাজার টাকায়। নতুন উত্তরা এলাকায় ৭ থেকে ৯ হাজার টাকার মধ্যে।
আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, গুলশান, বনানী ও ধানমন্ডি এলাকায় জমি সংকট। অন্যদিকে বড় গ্রাহক বা ক্রেতার পছন্দের জায়গা এই তিন এলাকায়। এতে এখানে ফ্ল্যাটের দাম অনেক বেশি, আগামীতে কমার সম্ভাবনা কম। অন্য এলাকায়ও দাম বাড়ছে ফ্ল্যাটের। নির্মাণ খরচ বেশি, উপকরণের উচ্চমূল্য আর ড্যাপের কারণে নতুন প্ল্যান পাস না হওয়ায় দাম আগামীতে আরও বাড়তে পারে।
সাবিহা তন্ময় একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পদে কর্মরত। প্রায় ১০ বছরের বেশি সময় ধরে চাকরি করছেন তিনি। থাকছেন ভাড়া বাসায়। তিনি সম্প্রতি বেশ কয়েকটি আবাসন কোম্পানির সঙ্গে কথা বলেন ফ্ল্যাট কেনার জন্য। তবে তার সঞ্চয় আর দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য না হওয়ায় ফ্ল্যাটের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তিনি বলেন, আশা ছিল জমানো সঞ্চয়ে রাজধানীতে একটা ফ্ল্যাট কিনবো, অন্তত বাসা ভাড়া বেচে যাবে। কিন্তু বাড়তি দামের কারণে এখন সেই স্বপ্ন আর পূরণ হবে না। বাড়তি দামে ফ্ল্যাটের স্বপ্ন দেখলে বাচ্চাদের পড়াশোনা করানো কঠিন। ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের দাম বাড়ার কথা স্বীকার করছেন আবাসন ব্যবসায়ীরাও। তারা জানান, নির্মাণ উপকরণের দাম কমলে ঘুরে দাঁড়াবে ব্যবসা। নির্মাণ উপকরণের অতিরিক্ত দাম বাড়ার ফলে ছোট ফ্ল্যাটের খরচই এখন ৭৫ লাখ টাকার বেশি পড়ছে। বড় বা মাঝারি ফ্ল্যাটের খরচ আরও বেশি। যদিও নির্মাণের প্রধান উপকরণ রড ও সিমেন্টের দাম কিছুটা কমেছে।
এ বিষয়ে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভুঁইয়া বলেন, গত আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়া ড্যাপে পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত এলাকার জন্য আলাদাভাবে ভবন নির্মাণের যে ফার নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি বৈষম্যমূলক। ড্যাপে বিদ্যমান বৈষম্য ও ক্ষেত্রবিশেষে অস্পষ্টতা দেখা দিয়েছে। বেশির ভাগ এলাকায় আগে ভবনের যে আয়তন পাওয়া যেত, সে তুলনায় এখন ৬০ শতাংশ পাওয়া যাবে। এতে জমির মালিক ও ফ্ল্যাটের ক্রেতা, ব্যবসায়ীসহ (বিক্রেতা) সবাই ক্ষতির মুখে পড়বেন।
উল্লেখ্য, ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করতে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ (২০২২-২০৩৫) তৈরি করেছে। গত বছরের আগস্টে যা কার্যকর হয়। ঢাকাসহ আশপাশের এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এ মহাপরিকল্পনা। যেখানে জনঘনত্ব ও অন্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নিয়ে ভবনের উচ্চতা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তবে সমালোচনার কারণে ওই ব্যবস্থা থেকে সরে এসে ফ্লোর এরিয়া রেশিওর (ফার) ভিত্তিতে ভবনের আয়তন নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়। এতে পরিকল্পিত এলাকার তুলনায় অন্য এলাকায় ভবনের আয়তন কমে যায়। উদ্যোক্তাদের সমালোচনায় কিছু জায়গায় সংশোধনের কথা জানায় রাজউক। যদিও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি এখনো।
আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ড্যাপের কারণে প্ল্যান পাসের সমস্যার সমাধান না হলে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে। চলমান প্রজেক্টে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে অলস সময় পার করতে হচ্ছে। নির্মাণ উপকরণের দাম বেশি হওয়ায় বিক্রিও এখন শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এখন লোকসান গুনতে হচ্ছে বিক্রির আশায়।