ড. তৌফিক এম সেরাজ। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। রিয়েল এস্টেট সেক্টরের সফল উদ্যোক্তা। তার প্রতিষ্ঠিত শেলটেক্ লিমিটেড সফলতার তিন দশক পার করে নেতৃত্ব দিচ্ছে বেসরকারি আবাসন শিল্পে।
রিয়েল এস্টেট ব্যবসার সার্বিক বিষয় নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। এ খাতের বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ, ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেন দীর্ঘ আলোচনায়। মানুষের আবাসন নিশ্চিত করতে না পারলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না বলে মত দেন। বলেন, এক্ষেত্রে সরকারের সুদৃষ্টিই পারে আবাসন শিল্পের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে। নানা অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন নিজের প্রতিষ্ঠান প্রসঙ্গেও। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু
জাগো নিউজ : উন্নয়নের নানা সূচকেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। উন্নয়নের ধারায় আবাসন শিল্প কোথায় যেতে পারল বলে মনে করেন?
তৌফিক এম সেরাজ : আবাসন শিল্পের যাত্রা ৩০-৩৫ বছর আগে। তবে প্রসার ঘটেছে গত ২০ বছর আগে। এই ২০ বছরের মধ্যে ৫-৬ বছর ধীরগতিতে গেছে। তবে আগামীর ১০ বছর ভালো সম্ভাবনা দেখছি। প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে আবাসন শিল্প এখন যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো এবং উন্নততর অবস্থায় আছে বলে মনে করি। এই শিল্পের সব উপকরণই এখন বাংলাদেশে ভালো তৈরি হয়।
রড, সিমেন্টসহ সব উপকরণেই পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তন এসেছে গত ১৫ বছরে। এর আগে বলতে পারেন কিছুই ছিল না। এসব বিবেচনায় আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। সরকার যদি আরেকটু সহায়তার ভঙ্গিতে দেখে, তাহলে আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশের নির্মাণ শিল্প অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস।
আপনি ১০ বছর আগে মানুষকে কোদাল দিয়ে মাটি কাটতে দেখেছেন যেসব প্রকল্পে, এখন সেখানে ভারী মেশিন দিয়ে মাটি খুঁড়তে দেখবেন। ভারী যান ব্যবহার করা হচ্ছে সর্বত্রই। এটি বড় পরিবর্তন। দ্রুত কাজ হয়, রাস্তা কম সময় বন্ধ থাকে। প্রকল্প ব্যয় কমে। পাইলিংয়ে এখন আর উচ্চ শব্দ হয় না। প্রয়োজনেই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে।
আমার প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাসহ নানা সুবিধা দেই। বিশেষ করে নিরাপত্তার দিক সবার আগে বিবেচ্য। আগে নির্মাণ শ্রমিককে লুঙ্গি পরা খালি গায়ে দেখতে পেতেন। আমার প্রতিষ্ঠানে এখন কোনো লুঙ্গি পরা শ্রমিক পাবেন না। মাথায় হেলমেট, হাতে গ্লাভস থাকছে। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আছে। আমরা এগিয়ে যাওয়ার বিশেষ অগ্রগামী, তা দাবি করতেই পারি।
আমি মনে করি, আমার শ্রমিক ভালো থাকলে উৎপাদন বাড়বে। তার স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারলে আমার প্রতিষ্ঠানের জন্য মঙ্গল। আমি তো তাকে অ্যাপার্টমেন্টে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারছি না। কিন্তু নির্মাণাধীন কোনো ভবনে ঘুমানোর ব্যবস্থা তো করতেই পারি।
জাগো নিউজ : আপনার প্রতিষ্ঠানের কথা বলছেন। এর বাইরেও তো গল্প আছে।
তৌফিক এম সেরাজ : পরিবর্তন যে আসছে না, তা নয়। একজনকে দেখেই আরেকজন পরিবর্তন করছে। আপনি মেট্রোরেলের শ্রমিকদের দেখেন। সবাই বুট, হেলমেট পরা। এর প্রভাব তো অন্য সেক্টরেও পড়বে। শ্রমিকদের পেছনে ব্যয় বাড়লে গ্রাহকের কাছেও দাম নিয়ে প্রতিযোগিতা করা যায়। সুস্থ প্রতিযোগিতার সুফল সবাই পাবে।
নির্মাণ শ্রমিকরা তো স্বাধীন। তারা একেবারেই ঐচ্ছিকভাবে এখানে শ্রম দেন। শ্রমিকরা তাদের সুবিধা মতোই এখানে শ্রম দিতে আসেন। তারা দরকষাকষি করেই মজুরি নির্ধারণ করেন। না পোষালে তারা একদিনও শ্রম দেবে না।
জাগো নিউজ : সরকারের সহায়তার কথা বলছিলেন। বিষয়টি যদি পরিষ্কার করতেন?
তৌফিক এম সেরাজ : অর্থনৈতিক উন্নয়নে আপনি আবাসন শিল্পের গুরুত্বকে অস্বীকার করতে পারবেন না। কিন্তু এরপরও বলতে হয়, সরকার কেন যেন এই সেক্টরে ঠিক নজর দিতে পারল না। এখনও জমির নিবন্ধন উচ্চমূল্যে নির্ধারণ করা। পাশের দেশ ভারতেও জমির নিবন্ধন এত টাকায় হয় না। উন্নত বিশ্বেও জমির নিবন্ধন অনেক কম। নিবন্ধন ফি এবং অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তর ফি কমানো গেলে ক্রেতারা সুবিধা পেত। সরকার যদি ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টরে সমন্বয় করতে পারত, তাহলে হয়তো নির্মাণ সামগ্রীর দাম কিছুটা কমে আসত।
অন্যদিকে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয় এবং এ কারণে প্রকল্প ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। সরকার চাইলে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এটি অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। এই সমস্যাগুলো দূর করতে পারলে সবাই লাভবান হবে। বিশেষ করে প্রথম সুবিধাভোগী হবেন অ্যাপার্টমেন্টের ক্রেতারা। কারণ অ্যাপার্টমেন্টের দাম কমলে ক্রেতারাই সরাসরি উপকৃত হবে।
ব্যাংকের সুদের হার কমানো সময়ের দাবি। সামনে বাজেট। সরকার আবাসন খাতকে এবারে বিশেষভাবে বিবেচনায় নেবে বলে আশা করছি। বিশেষ করে জমির নিবন্ধন এবং অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তর ফি যদি কিছুটা কমিয়ে আনা যায়, তাহলে এ সেক্টরের উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে। জমির নিবন্ধন ফি কমলে আবাসন শিল্পে বিপ্লব ঘটবে। ব্যবসার প্রবৃদ্ধি বাড়লে রাজস্ব বাড়বে। ব্যবসার প্রসার ঘটলেই কেবল প্রবৃদ্ধি বাড়বে।
একজনকে সুবিধা দিয়ে ১০০ টাকা লাভ করার চেয়ে ১০ জনকে সুবিধা দিয়ে ১০০ টাকা লাভ করলে ব্যবসার পরিধি বাড়ে। এতে সমতা বাড়ে। এজন্য সরকারকেই আগে ভূমিকা রাখতে হবে। ট্যাক্স এবং ভ্যাটের ব্যাপারে সরকার যদি ব্যবসায়ীবান্ধব হয়, তাহলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই উপকৃত হবে। ব্যবসার প্রসার ঘটবে। সুফলভোগী মানুষের সংখ্যার দিক দিয়ে রাজস্বও বাড়বে। বছরে ১০ হাজার অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তর হলে যে রাজস্ব পাবে, ২০ হাজার হলে তার চেয়ে অধিক পাবে। ২০ হাজার অ্যাপার্টমেন্ট হস্তান্তর করার সুযোগ তৈরি করতে পারে নিবন্ধন খরচ কমিয়ে।
বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে যাচ্ছে। এমন দেশে বিক্রি যত বাড়বে, ততই রাজস্ব আয় বাড়বে। আজ যে ১ হাজার বর্গফুটের বাড়ি কিনবে ৫ বছর পর সে কিন্তু ২ হাজার বর্গফুটের বাড়ি কিনতে চায়বে। তার মানে সে একটি বিক্রি করে আরেকটি কিনবে। একই ব্যক্তির কাছ থেকে রাষ্ট্র দুইভাবে রাজস্ব পাচ্ছে। তবে সেটা ওই ব্যক্তির জন্য অবশ্যই ক্রয় উপযোগী করে তুলতে হবে।
এ কারণেই বলি, স্বল্পমেয়াদের কথা বিবেচনা করে উন্নয়ন হতে পারে না। টেকসই উন্নয়নের সময়কাল হওয়া দরকার কমপক্ষে ৫০ বছর। এমন উন্নয়নে সুফলভোগীর হাত বদল হবে বারবার। এতে রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি সবাই উপকৃত হবে।
আমি মনে করি, রিয়েল এস্টেট খাত একটি দেশের উন্নয়নের সূচক। অপ্রত্যাশিতভাবে দেশের কোনো কোনো নীতিনির্ধারক এই খাত নিয়ে নেতিবাচকভাবেই মন্তব্য করেছেন। তারা মনে করেন, রিয়াল এস্টেট খাত অনুৎপাদনশীল খাত। বাসস্থান মানুষের মৌলিক চাহিদা। এমন একটি খাতকে তো কোনোভাবেই অনুৎপাদনশীল খাত বলে বিবেচনা হতে পারে না। মানুষ তার আশ্রয়স্থলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলে সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে। আর জীবনযাপনের সঙ্গে সকল উৎপাদন নির্ভর করে। নিজের আত্মবিকাশের জন্যই সুন্দর আশ্রয়স্থল দরকার। নিজের একটি বাড়ি থাকা মানেই তো বিশ্বাসে মালিকানা ভাব চলে আসে।
জাগো নিউজ : আপনার প্রতিষ্ঠান শেলটেক এখন কোথায় দাঁড়িয়ে?
তৌফিক এম সেরাজ : আমরা এখন বড় জায়গা নিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট তৈরি করছি। যেখানে শত শত ফ্ল্যাট থাকছে। এতে আমরা বেশি করে সুযোগ দিতে পারি। আমরা মিরপুর মাজার রোডে শেলটেক্ বিথীকা নামের অ্যাপার্টমেন্ট করেছি। সেখানে সুইমিংপুল, জিমনেশিয়াম, হাঁটার জায়গা, বাচ্চাদের খেলাধুলার জায়গা, সামনের ভাগে পানির ফোয়ারা, বাগান রয়েছে- যা গুলশান, বারিধারায়ও সাধারণত দেখতে পাওয়া যায় না।
অথচ আমরা এখানকার ফ্ল্যাট বিক্রি করছি ৬ হাজার ৪০০ টাকা করে প্রতি বর্গফুট। এই বাড়িটি ধানমন্ডিতে বানিয়ে বিক্রি করতাম প্রতি বর্গফুট ১৮ হাজার টাকা। এখানে প্রবেশ করার পর আপনি বুঝতে পারবেন বাংলাদেশের আবাসন শিল্পের চিত্র বদলে গেছে। আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট দেখে পাশেই একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। আমার একটি প্রজেক্ট সেখানকার চিত্র বদলে দিয়েছে। জমির দাম তিনগুণ বেড়ে গেছে। এর সুফল এখন সবাই পাচ্ছে।
জাগো নিউজ : মিরপুরের শেলটেক্ বিথীকায় কয়টি অ্যাপার্টমেন্ট আছে?
তৌফিক এম সেরাজ : এখানে আমরা ১৮৪টি অ্যাপার্টমেন্ট করেছি। আমাদের এখনকার সব প্রকল্পই এ রকম। সবই একশ’র ওপরে। সবই কেন্দ্রীয় ঢাকায়। অ্যাপার্টমেন্টের সাইজ ছোট করে আনছি। শেলটেক বিথীকায় ১ হাজার ৪০০ বর্গফুটের বাড়ি। তবে এরপর আমরা ১২০০ বর্গফুট টার্গেট করেছি।
জাগো নিউজ : শেলটেক নিয়ে কোথায় যেতে চান?
তৌফিক এম সেরাজ : আমার প্রতিষ্ঠান শেলটেক এর ৩১ বছর হয়ে গেছে। এখন আর কোথায় যাব? আবার ফেরারও পথ নেই। গত তিন দশকে যে সুনাম অর্জন করেছি, তা ধরে রাখাই এখন কাম্য। আমি মনে করি, যারা শেলটেকের সঙ্গে জড়িত তারা ধীরে ধীরে শত বছরে নিয়ে যাবে। আমরা এখন অত্যন্ত আধুনিক মানের নকশায় বাড়ি করছি। মার্কেট কী চায়, তার ওপরই আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। ক্রেতাদের ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতে চাইছি না।
এ কারণে আমরা রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নামের উইং করেছি, যা অন্য প্রতিষ্ঠানের নেই বলে জানি। আমরা ঢাকার পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত বলে আগামীর অনেক কিছুই বুঝতে পারছি। শহরের প্রবৃদ্ধিটা আগে থেকেই বুঝতে পারি এবং এটি আমাদের কিছুটা বাড়তি সুবিধা দেয়। অন্যরা যেখানে প্রজেক্ট নিতে সাহস পায় না, আমরা সেখানে দিব্যি প্রজেক্ট করছি। মিরপুরের শেলটেক বিথীকা তার প্রমাণ।
শেলটেক বিথীকার পাশ দিয়ে মেট্রোরেল যাবে। তখন মাজার রোড থেকে গুলিস্তানের দূরত্ব হবে মাত্র ১৯ মিনিট, এখন যেখানে সময় লাগে দেড়-দুই ঘণ্টা। পাঁচ বছর পর সেখানকার ফ্ল্যাটের দাম দ্বিগুণ হবে। বাড়ি ভাড়াও বেড়ে যাবে। মুনাফার পাশাপাশি আমরা দূরদর্শী ভাবনা নিয়ে ক্রেতা সাধারণের কাছেই থাকতে চাই।