প্রতিবেদক : আবাসন খাতের চিত্রটা এখন কেমন? নির্বাচনের কারণে একটি রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, এ খাতে কী প্রভাব ফেলেছে?
আলমগীর শামসুল আলামীন: প্রতিটি নির্বাচনের আগেই বাজার কিছুটা স্থবির হয়। অতীতেও হয়ে এসেছে। মানুষের মনে আশঙ্কা থাকে, নির্বাচনের কারণে কোনো বিশৃঙ্খলা হতে পারে। এবারের নির্বাচনে সে ধরনের বিশৃঙ্খলার কোনো ঘটনা ঘটেনি। আশা করা যায়, মানুষের মধ্যে আবাসন খাত নিয়ে আস্থা ফিরে আসবে। এ খাতে সাড়ে চার বছর ধরে মন্দা যাচ্ছিল। তবে এর ভেতরও আবাসন বাজার উন্নতি করছিল। আরেকটি জিনিস মনে রাখতে হবে, ক্রেতারা সব আবাসন ব্যবসায়ীর কাছে যান না। যাঁরা সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছেন, সরকারি আইন মেনে চলছেন, রাজউকের প্ল্যান অনুসরণ করে নির্মাণকাজ করছেন, তাঁদের কাছেই ক্রেতারা যাচ্ছেন। ভবিষ্যতেও যাঁরা সুনাম অর্জন করতে পারবেন, তাঁদের কাছেই ক্রেতারা যাবেন। আবাসন খাতে এখন কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে। ফ্ল্যাটের দাম কমে যাচ্ছিল। এটা এখন স্থিতিশীল। যাঁরা ভালোভাবে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন, আবাসন খাতে তাঁদের অবস্থা ভালো। এ ব্যবসা তাঁদের জন্যই খারাপ, যাঁরা সুনাম ও প্রতিশ্রুতি ঠিকঠাক রাখতে পারেননি।
প্রতিবেদক : বেশির ভাগ ফ্ল্যাটই সাধারণ মানুষের নাগালে নেই বলে ক্রেতাদের অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে আপনারা কী বলেন?
আলমগীর শামসুল আলামীন: এ অভিযোগের সঙ্গে আমি একমত। আমাদের দেশের মানুষের কেনাকাটার যে সামর্থ্য, সে তুলনায় আবাসন খাতের বাজার এখনো সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে।
প্রতিবেদক : তাহলে ফ্ল্যাটের দাম সাধারণ মানুষের নাগালে আনার উপায় কী?
আলমগীর শামসুল আলামীন: এ বাজার মানুষের নাগালে আনতে হলে নীতিমালার প্রয়োজন আছে। ঢাকার বাইরে স্যাটেলাইট সিটি করতে হবে। ঢাকায় জমির দাম বেশি। ঢাকায় ফ্ল্যাট নির্মাণ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয়ের মধ্যে আবাসন ব্যবসায়ীরা ফ্ল্যাট দিতে পারেন না। সারা দেশে রড, সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম এক। শুধু জমির দামে হেরফের। ফ্ল্যাটের ক্রেতারা সবাই ঢাকামুখী। ঢাকার বাইরে অবকাঠামোগত উন্নয়নও দেখছি না। এসব উন্নয়ন যখন হবে, তখন আবাসন ব্যবসায়ীরা ঢাকার বাইরে যাবেন। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস হলে ঢাকার বাইরে ব্যবসায়ীদের কাজের পরিধি বাড়বে। এ ছাড়া ক্রেতাদের ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ তৈরি করতে হবে। ঋণসুবিধা বাড়াতে হবে। কিস্তি হতে হবে দীর্ঘমেয়াদি। এক কোটি টাকা দামের একটি ফ্ল্যাট কিনতে একজন ক্রেতার পক্ষে এককালীন টাকা দেওয়া কষ্টসাধ্য। ঋণের ওপর সুদের হার কমিয়ে আনতে হবে।
প্রতিবেদক : জেলা শহর কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে আপনাদের কোনো আবাসিক প্রকল্পের কাজ হচ্ছে কি?
আলমগীর শামসুল আলামীন: ক্রেতাদের চাহিদা ঢাকামুখী হওয়ায় এখন আবাসন ব্যবসার প্রায় পুরোটা জুড়ে আছে ঢাকা। আবাসন ব্যবসায়ীদের ৯৮ শতাংশ ঢাকায় বিনিয়োগ করছেন। আর মাত্র ২ শতাংশ ঢাকার বাইরে কাজ করছেন।
প্রতিবেদক :বেশিসংখ্যক মানুষকে আবাসিক সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?
আলমগীর শামসুল আলামীন: এর উত্তরও একই। ক্রেতাদের ফ্ল্যাট কেনার সুযোগ তৈরিতে দীর্ঘমেয়াদি কিস্তিতে কম সুদে ঋণ দিতে হবে। পৃথিবীর সব উন্নত দেশেই সাধারণ মানুষকে এই নীতির মাধ্যমে বাড়ির মালিক করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, গৃহঋণের ক্ষেত্রে খেলাপি সবচেয়ে কম। আবাসন খাতে অর্থায়ন করে যেসব প্রতিষ্ঠান, তাদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন, গৃহঋণে খেলাপি হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে কম পাবেন। ব্যাংক, সরকার, বিনিয়োগকারীদের জন্য আবাসন খাত হচ্ছে বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে সুরক্ষিত ও নিরাপদ জায়গা।
প্রতিবেদক : আবাসন ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা আছে। এটা কাটিয়ে ওঠা কীভাবে সম্ভব বলে মনে করেন?
আলমগীর শামসুল আলামীন: রিহ্যাবের সদস্য এখন ১১০০-রও বেশি। সদস্যরা ঢাকা ও চট্টগ্রামভিত্তিক। এতটুকু শহরে এত সদস্যের কোনো প্রয়োজন ছিল না। আবাসন খাতের সুরক্ষার জন্য সরকারের কোনো নীতিমালা ছিল না। আমি প্রেসিডেন্ট হওয়ার সময় আবাসন ব্যবসায়ীদের জন্য নিজস্ব মূলধনের নীতিমালা ছিল না। আমি এসে বাধ্যতামূলক করেছি, রিহ্যাবের সদস্য হতে হলে নিজস্ব মূলধন ন্যূনতম এক কোটি টাকা হতে হবে। অনেকে ৫০ হাজার টাকা মূলধন নিয়েও এ ব্যবসায় নেমে পড়েছেন। আবাসন ব্যবসায় ধস নামার পর এই ব্যবসায়ীরা টাল সামলাতে পারেননি। প্রকল্প শেষ করতে পারেননি। ব্যাঙের ছাতার মতো অনেকে আবাসন ব্যবসায়ী হয়েছিলেন, তাঁরা টিকে থাকতে পারেননি। ফ্ল্যাট হস্তান্তর ঠিকমতো করবেন না। আবার বলবেন ব্যবসা খারাপ, তা তো হবে না।
প্রতিবেদক : উন্নত দেশের চেয়ে আমাদের আবাসন খাত কতটা পিছিয়ে?
আলমগীর শামসুল আলামীন: আমাদের ও উন্নত দেশের প্রেক্ষাপট এক নয়। এ দেশের প্রেক্ষাপটেই এ দেশের ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করছেন। তাঁরা সাহসী। প্রতিকূলতার মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে এ ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এ দেশ এখন তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ে গর্বিত। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। রিজার্ভ, রপ্তানি বেড়েছে। আমি বিশ্বাস করি, সরকার যদি সহানুভূতি দেখায় এবং নীতিমালা ব্যবসাবান্ধব হলে দেশটি আরও ওপরে যেতে পারবে।
প্রতিবেদক : অভিযোগ আছে, ফ্ল্যাট বুঝে না পেলে রিহ্যাবে অভিযোগ করে কোনো ফল পাওয়া যায় না?
আলমগীর শামসুল আলামীন: এ অভিযোগ সত্য নয়। রিহ্যাব প্রতিবছর গড়ে ছয়-সাত হাজার ফ্ল্যাট ক্রেতাদের কাছে হস্তান্তর করে। সে তুলনায় অভিযোগ কত? আমি চার বছর ধরে রিহ্যাবের প্রেসিডেন্ট। দায়িত্ব নেওয়ার সময় অভিযোগ ছিল ১১০০-র মতো। এখন ১৭০টি অভিযোগ বকেয়া আছে। চার বছরে প্রায় ২৪ হাজার ফ্ল্যাট হস্তান্তর হয়েছে, সেই হিসাবে অভিযোগ কি খুব বেশি? ক্রেতার প্রতিটি অভিযোগ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়। অভিযোগ নেওয়া ও প্রতিকারের জন্য আলাদা সেল রয়েছে। একটি কমিটির মাধ্যমে দুই পক্ষকে ডেকে অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয়।
প্রতিবেদক : রিহ্যাবের বাইরেও আবাসন ব্যবসায়ী আছেন। এঁদের ব্যাপারে রিহ্যাব কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে কি না বা সরকার কী করতে পারে বলে মনে করেন?
আলমগীর শামসুল আলামীন: রিহ্যাবের বাইরেও অনেক প্রতিষ্ঠান আবাসন ব্যবসা করছে। রিহ্যাব শুধু সদস্যদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে পারে। সদস্য নয়, এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। তবে এক বছর হলো, সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, আবাসন ব্যবসা করতে হলে রিহ্যাবের সদস্য হতে হবে। ৩৫-৪০টি প্রতিষ্ঠান সদস্য হতে আবেদন করেছে এ মুহূর্তে। আমাদের নির্ধারিত মানদণ্ড পূরণ করলেই সদস্য করা হবে। যাঁরা রিহ্যাবের সদস্য নন, আমি যত দূর জানি, তাঁরা ব্যাংক থেকে কোনো বিনিয়োগ সুবিধা পাচ্ছেন না।
ক্রেতাদের জন্য পরামর্শ হচ্ছে, দেখেশুনে যাচাইবাছাই করে আবাসন ব্যবসায়ীর কাছে যাবেন। আর গণমাধ্যমেরও দায়িত্ব রয়েছে, বিজ্ঞাপন ছাপানোর আগে আবাসন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজউকের প্ল্যান আছে কি না, তা দেখে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা। কারণ প্রথম আলোর মতো সংবাদপত্রে মানুষের আস্থা অনেক বেশি থাকে। এখানে বিজ্ঞাপন প্রকাশ হলে মানুষ তা বিশ্বাস করে।
প্রতিবেদক : আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ
আলমগীর শামসুল আলামীন: আপনাকেও ধন্যবাদ
প্রথম আলো থেকে নেয়া