১৯৮৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছরের অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্ব বসতি দিবস পালিত হয়ে আসছে। এবার ২০১৮ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘নগরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা’ (Municipal Solid Waste Management ) এবং স্লোগান Waste-wise cities । ২০১৭ সালে বিশ্ব বসতি দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘গৃহায়ণ নীতিমালা : সাধ্যের বসতি’ (Housing Policies : Affordable Homes). আর স্লোগান ‘গৃহায়ণই উন্নয়নের কেন্দ্র’। গতবছর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন অধিদফতর, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (রাজউক) আবাসন খাতের বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন আয়োজনে দিবসটি পালন করেছিল। বিশ্ব বসতি দিবসের বছরওয়ারী যে প্রতিপাদ্য ঘোষণা করা হয়, দিবসটি পালনের পর সেই প্রতিপাদ্য, চেতনা, আহ্বান, ঘোষিত কর্মপরিকল্পনা ও গৃহীত প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনায় দেখা গিয়েছে এগুলোর অধিকাংশই আনুষ্ঠানিকতাতেই সীমিত রয়েছে। মনে হয়েছে অনেকটা প্রচার সর্বস্ব দিবস পালন।
এ যাবৎ বত্রিশটি বিশ্ব বসতি দিবসের প্রতিপাদ্যের সিংহভাগে রয়েছে ছিন্নমূলদের আশ্রয়দান, বসবাসযোগ্য আবাসন গড়ে তোলার প্রত্যয় আর নগর উন্নয়নের অভিপ্সা। বাংলাদেশে ছিন্নমূল মানুষের আবাসনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলা হলেও এখনো তা অপ্রতুল। নিয়ম করে আরও একটি বিশ্ব বসতি দিবস হাজির হলেও এসব বাস্তুহারা মানুষের আবাসন স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। ‘ইন্টার্নাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার’ ও ‘নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলে’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বছরে বাংলাদেশে গড়ে অন্তত ৮-১০ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন। চলতি বছর কীর্তিনাশা খ্যাত পদ্মা নদীর আগ্রাসনে জনবহুল জনপদ নড়িয়ার নিশ্চিহ্ন হওয়ার হিসাবে নিলে এই সংখ্যা হবে আরও বেশি। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছয়টি এলাকার মানুষ সবচেয়ে বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আর দেশের বিভিন্ন দুর্যোগে বাস্তাহারা হওয়া মানুষদের বেশিরভাগই আশ্রয় নেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে। এসব মানুষের ন্যূনতম আবাসন সুবিধা নিশ্চিত না করেই পালিত হচ্ছে এবারের ‘বিশ্ব বসতি দিবস ২০১৮’।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সরকারের বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প থাকলেও এর সুবিধাভোগীরা হলেন সরকারি কর্মকর্তা, সম্পদশালীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। এদের অধিকাংশই বসবাস করেন রাজধানী ঢাকাতে। অথচ বাস্তুহারা, দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তরা সরকারি আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন না। এছাড়া, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর টেকসই আবাসন নিয়ে এখনো সরকারের দৃশ্যমান কোনো পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। বেসরকারি এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে সরকারিভাবে ১৭ শতাংশ মানুষের টেকসই আবাসন নিশ্চিত করা হয়েছে। আর বেসরকারি উদ্যোগে হয়েছে ১৯ শতাংশ মানুষের। ৪৪ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বসবাস করছে। এছাড়া, ২০ শতাংশ মানুষ খোলা আকাশের নিচে এবং ব্যক্তিগত দুর্বল অবকাঠামোর বাসভবনে বসবাস করছে।
ঢাকার ৩০ হাজার পথবাসী মানুষের ওপর একটি জরিপ চালায় বেসরকারি সংস্থা কোয়ালিশন ফর দ্য আরবান পুওর (কাপ)। ওই জরিপে দেখা গেছে, শতকরা ২১ ভাগ মানুষ ১ থেকে ৪ বছর ধরে ঢাকার খোলা আকাশের বাস করছেন। এছাড়া, ১৬ ভাগ মানুষ ৫ থেকে ৯ বছর ধরে, ১৯ ভাগ মানুষ ১০ থেকে ১৪ বছর ধরে এবং ৪৪ ভাগ মানুষ ১৫ বছরের ওপর খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। এসব মানুষের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ফুটপাতেই সারাজীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন এমন লোকও কম নয়। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সাজেদা ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকা শহরের ফুটপাতেই ৩০ হাজার মানুষ জীবনযাপন করছে। অন্যান্য শহরেও রয়েছে আরও ২০ হাজারের বেশি মানুষের বাস। আর ঢাকা শহরের বস্তিগুলোতে বসবাস করছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ।
বিশ্বব্যাংকের এক জরিপে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় প্রতিবছর তিন থেকে চার লাখ নতুন মানুষ যোগ হচ্ছে। এদের অধিকাংশই হতদরিদ্র। বাসাবাড়িতে থাকার আর্থিক সাধ্য না থাকায় তাদের থাকতে হয় বস্তিতে। পরে তাদের অনেককেই বস্তি থেকে উচ্ছেদ হয়ে ঠাঁই নিতে হয় ফুটপাতে। আশার কথা, রাজধানীর মিরপুরে বস্তিবাসীর জন্য দৈনিক ২৭০ টাকা ভাড়াভিত্তিক ১০ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে ২০ হাজার পরিবারের আবাসনের ব্যবস্থার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু কবে নাগাদ এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না কেউ। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ২০২১ সালের মধ্যে দেশের আবাসন সংকট নিরসনে বহুমুখী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব উদ্যোগের মধ্যে রাজধানীর বাইরেও উপজেলা পর্যায়ে ফ্ল্যাট ও প্লট প্রকল্প রয়েছে।
২০১০ সালে সম্পাদিত সমীক্ষায় বলা হয়েছে প্রতিদিন প্রতি ব্যক্তি ০.৮ কিলোগ্রাম বর্জ পরিত্যাগ করে সেই হিসাবে আহার বিহার ভোগ বৃদ্ধির বিপরীতে কার্যকর ব্যবস্থাপনা না নিলে বিশ্বব্যাপী পরিত্যাজ্যের সাকুল্য পরিমাণ ২০২৫ সালে দাঁড়াবে ৫.৯ বিলিয়ন টন। শুধু মিউনিসিপালিটি নয় জাতীয় সরকারগুলোকেও এ ব্যাপারে কার্যকর বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রসঙ্গত যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা (এসডিজি), ২০১৬ সালের প্যারিস এগ্রিমেন্ট এবং নিউ আরবান এজেন্ডাার মতো আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তসমূহে সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এসডিজি ১১.৬ এর লক্ষ্যমাত্রায় নগরকে নিরাপদ ও জীবনযাপনের উপযুক্তকরণের লক্ষমাত্রা দেওয়া হয়েছে। এর অওতায় ১১.৬.১ ইনডিকেটর এ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্বারোপ করে লক্ষ্যমাত্রা বেধে দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মিউনিসিপালিটিগুলোর বাজেট সংস্থান সামান্য, গৃহীত উদ্যোগের তদারকি দুর্বল।
লেখক : ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের প্রাক্তন চেয়ারম্যান