প্রগতি সরণি এলাকার একটি রড-সিমেন্টের দোকানে শ্রমিকের কাজ করতেন শহিদুল ইসলাম। চার সদস্যের পরিবারের খরচ চালাতে না পেরে সম্প্রতি ভাড়ায় অটোরিকশা চালানো শুরু করেছেন। দিনের বেলায় দোকানে শ্রমিকের কাজ করেন। রাতে বেরিয়ে পড়েন অটোরিকশা নিয়ে। আলাপকালে শহিদুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আগে কাজারে জন্য দম ফেলার সুযোগ ছিল না। দিন-রাত কাজ করতাম, ইনকামও ভালো হতো। কিন্তু বছরখানেক ধরে দোকানে তেমন কাজ নেই। আর কাজ না থাকলে আমাদের ইনকামও থাকে না। তাই পরিবারের খরচ চালাতে রাতে অটোরিকশা চালাচ্ছি।’
একই এলাকার ভ্যানচালক স্বপন বিশ্বাস বলেন, ‘আগের চেয়ে কাজ অনেক কমে গেছে। সারা দিনে তিন থেকে চারটা ট্রিপ মারতে পারি। জমার টাকা দিয়ে নিজের তেমন থাকে না।’
শুধু শহিদুল বা স্বপনের জীবনেই নয়, আবাসন খাতের চলমান মন্দার প্রভাব পড়েছে দেশের প্রায় সব খাতে। সরাসরি এই খাতে জড়িত লোকজন ছাড়াও দুই শতাধিক লিংকেজ প্রতিষ্ঠানের ওপরও এর প্রভাব পড়েছে।
অর্থনীতিবিদ এবং আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, আবাসন খাত সচল হলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হবে। এখন এ খাতে মন্দা থাকায় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তারা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের আয়ের অধিকাংশই খরচ হয়ে যাচ্ছে। সঞ্চয়ের সুযোগ কমে যাচ্ছে। খাবার, বাড়িভাড়াসহ অন্য খাতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় ভবিষ্যতের আবাসন নিয়ে বাড়তি সঞ্চয় করার ইচ্ছা থাকলেও, তা সম্ভব হচ্ছে না অনেকের। তা ছাড়া, যারা ঋণ নিয়ে আবাসনের সংস্থান করতেন, মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চসুদের নীতির কারণে সেটাও সবার জন্য সম্ভব হচ্ছে না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আবাসন খাতটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। অর্থনীতিতে এর বড় অবদান আছে। জিডিপিতেও অবদান আছে, কর্মসংস্থানেও অবদান আছে। আমাদের বিভিন্ন অধিকারের মধ্যে একটি আবাসন।’
তবে সম্প্রতি আবাসন খাত কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখন মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যে আছে, আবার আবাসন খাতের জন্য ব্যাংকের যে ঋণ, তার সুদও অত্যন্ত বেশি। সুতরাং ঋণ নিয়ে এখন আবাসনে বিনিয়োগ করা বেশ চ্যালেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে।’ অবশ্য সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল হলে স্বাভাবিক হবে ভেরও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এগুলোর সঙ্গে বিনিয়োগ, আয়, কর্মসংস্থান ও ঋণের সম্পর্ক আছে। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা এলে এগুলো সামগ্রিকভাবে আবার চাঙা হবে। চাহিদার দিক থেকে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রবণতা আছে, যার প্রভাব আবাসন খাতের ওপরও পড়ছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আবাসন খাতের নিম্নমুখী অবস্থার প্রভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিগুলোও বিপাকে পড়েছে। চাহিদা কম থাকায় রড-সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর দামও কমেছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে তাদের আরও বেকায়দায় পড়তে হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর অক্টোবরের তথ্য বলছে, দেশের নির্মাণসামগ্রীর দাম পড়তির দিকে। গত অক্টোবর শেষে বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস প্রাইস ইনডেক্স কমে ৬ দশমিক শূন্য ১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। যেটি ২০২৩ সালের একই সময়েও ছিল ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ।
বিবিএসের এ তথ্যে আরও দেখা যায়, এ খাতের নির্মাণসামগ্রীর দামও কমেছে ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ, এক বছর আগের একই সময়েও তা ছিল ৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। নির্মাণ খাতের শ্রমিকদের মজুরি অবশ্য বেড়েছে। অক্টোবর শেষে মজুরি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যেখানে আগের বছরের অক্টোবরে মজুরি ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রিগুলো বিশেষ করে রড, সিমেন্টসহ অন্য সামগ্রীতে একটি প্রভাব পড়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতি আবার ফিরে এলে আমাদের কর্মসংস্থান বিনিয়োগ নির্ভর করবে। তা ছাড়া আরেকটি বাজেটও আসছে, সেখানেও চিন্তা করা যেতে পারে, স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সুবিধা রাখার জন্য।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, রডের দাম গত এক বছরে প্রায় ১২ শতাংশ কমেছে। ব্যবসায়ী ও উৎপাদকরা বলছেন, নির্মাণ খাতের প্রধান উপকরণ রডের দাম গত বছর লাখ টাকা ছাড়িয়েছিল। এ বছরের আগস্টে সরকারের পটপরিবর্তনে পরপর অবকাঠামো খাতে ধীর গতি দেখা দেয়। তাতে কারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নামিয়ে আনতে বাধ্য হন উদ্যোক্তারা।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএমএ) সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের কাছে নীতি সহায়তা চেয়েছে। ওই সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে বাজারমূল্যের অসংগতিতে ব্যবসা কমেছে বহু উদ্যোক্তার। ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে ইস্পাত উৎপাদনে খরচ বেড়েছে ৬৫ শতাংশ। পাশাপাশি গ্যাসের দরও বেড়েছে। ফলে প্রতি টন রডে ২ হাজার টাকা দাম বেড়েছে। একই অবস্থা সিমেন্ট, বালু, ইটপাথরের ক্ষেত্রেও।
আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশনের (রিহ্যাব) তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ১৫ হাজারের কাছাকাছি ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়েছে। এরপর ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সেটি নেমে বছরে গড়ে ১২ হাজারের কিছু বেশিতে ঠেকে। ২০১৭-২০ পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ১৩ থেকে ১৪ হাজারে দাঁড়ায়। ২০২০ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত প্রতিবছর ১৫ হাজারের কাছাকাছি ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয়েছে। এরপর নির্মাণ উপকরণের মূল্য বেড়ে যায়, যার প্রভাব দেখা যায় ফ্ল্যাট-অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রিতে। সঙ্গে শুরু হয় কভিড মহামারী। ফের কমে যায় কেনাবেচা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিক্রি হয় ১০ হাজারের কাছাকাছি এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংখ্যাটি ১০ হাজারের নিচে নেমে যায়।
রিহ্যাবের পরিচালক এবং রিচমন্ড ডেভেলপার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএফএম ওবায়দুল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আবাসন খাতকে কেন্দ্র করে এরই মধ্যে অনেক বিদেশি সিমেন্ট, রং, টাইলস কোম্পানির বিনিয়োগে বাংলাদেশে কারখানা হয়েছে। আগে রড, সিমেন্ট, টাইলস, রং আমদানি করা হতো। এখন এসব দেশেই তৈরি হচ্ছে। এতে আমাদের কর্মসংস্থানের সুযোগও বেড়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর এই খাত নিয়ে নীতিরও পরিবর্তন করতে হবে। তাহলে এই সেক্টরের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন হবে। আরও নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।’ তিনি বলেন, পৃথিবী উন্নত দেশের অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখে রিয়েল এস্টেট সেক্টর। রিয়েল এস্টেট সেক্টর বাদ দিয়ে উন্নত দেশ গড়া সম্ভব নয়। তাই উন্নত দেশ গড়তে হলে আগে রিয়েল এস্টেট সেক্টরকে গুরুত্ব দিতে হবে।