রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেছেন, আগের ড্যাপে ভুল-ত্রুটি আছে। তাই এবার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে, তাদের সহযোগিতা নিয়ে নতুন ড্যাপ প্রণয়ন করা হবে। ‘আগের ড্যাপ অন্ধকার ঘরে বসে করা হয়েছিল। তাই তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে বাস্তবসম্মত একটি ড্যাপ প্রণয়ন করলে তা পরিকল্পিত নগরায়ণে বিশেষ ভূমিকা রাখবে’—বুধবার রাজউকের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় স্টেকহোল্ডারদের এ ধরনের পরামর্শ ও দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজউক চেয়ারম্যান ওই বক্তব্য দেন।
মতবিনিময় সভায় স্টেকহোল্ডারদের প্রতিনিধিরা আরো পরামর্শ দেন—ঢাকা শহরকে বাসযোগ্য করতে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা সচল করা জরুরি। আর এ জন্য রাজধানীর তালিকাভুক্ত ৫৮টি খাল উদ্ধার করতে হবে। রাজউক এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে বেসরকারি সংস্থাগুলো আর্থিকসহ সব ধরনের সহযোগিতা করবে। একই সঙ্গে ভূমির আধুনিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে উন্নত বিশ্বের মতো আধুনিক পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ—রাজউক ভবনের সম্মেলন কক্ষে ‘ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) ২০১৬-২০৩৫’ বিষয়ে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব), ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই), বাংলাদেশ ল্যান্ড ডেভেলপারস অ্যাসোসিয়েশন (বিএলডিএ), ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই), বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ পুলিশের সঙ্গে রাজউকের মতবিনিময় সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।
রাজউক চেয়ারম্যান আবদুর রহমানের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রধান সমন্বয়ক মেজর জেনারেল আবু সাঈদ মো. মাসুদ, বিএলডিএর চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান ও মহাসচিব মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন, রাজউকের সদস্য (পরিকল্পনা) জিয়াউল হাসান, পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) মফিজুল হক, ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলামসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি।
মতবিনিময় সভায় বিএলডিএর চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, আগের ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছিল অন্ধকার ঘরে বসে। কারো মতামত না নিয়ে তা সই-স্বাক্ষর করে দেন সংশ্লিষ্টরা। এ ড্যাপের কারণে মানুষ সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হয়েছে। ড্যাপ ঘোষণার পরপরই সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। সেই সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি বুঝতে পেরে ড্যাপ সংশোধনের নির্দেশনা দেন।
বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান আরো বলেন, ‘নতুন ড্যাপ সবার অংশগ্রহণমূলক করে বাস্তবতার নিরিখে করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, সে জন্য সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানাই। আমরা আশা করব, রাজউক এবার বাস্তবভিত্তিক ড্যাপ প্রণয়ন করবে, আর এটা করলে আমরা সে সব সংশোধনে সহযোগিতা করব। এক সময় ঢাকা শহরে তালিকাভুক্ত ৫৮টি খাল ছিল। আজ হাতে গোনা কয়েকটি খালের অস্তিত্ব চোখে পড়ে। খালগুলো উদ্ধার করা গেলে আমরা সামান্য বৃষ্টিতেই জলমগ্ন হয়ে পড়তাম না। ’ তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট সংস্থা থেকে খাল উদ্ধারে কাজ শুরু করলে আমরা বিএলডিএর পক্ষ থেকে ৫০ কোটি টাকার আর্থিক সহযোগিতা দেব। ’
সভায় এফবিসিসিআই প্রতিনিধি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা আবাসন, শিল্পায়নসহ নানাবিধ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। উন্নত বিশ্বে আবাসন খাতকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ কারণে ড্যাপ প্রণয়নে স্টেকহোল্ডারদের মতামত গ্রহণ করতে হবে। আগের ড্যাপ প্রণয়নে ব্যবসায়ীসহ সব শ্রেণির মানুষকে উপেক্ষা করায় ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপ হয়েছে। এবার সংশোধিত ড্যাপে জনগণের মতামত গ্রহণ করার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। ’
ডিসিসিআই প্রতিনিধি ফজলুল করিম বলেন, ‘আমরা মনে করি, রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্তদের উচিত হবে বিভিন্ন পেশাভিত্তিক সংগঠনের সঙ্গে পৃথকভাবে বসে আলাপ-আলোচনা করে মতামত গ্রহণ করা। এভাবে ড্যাপ প্রণয়ন করলে একটি কার্যকর এবং বাস্তবভিত্তিক ড্যাপ প্রণয়ন করা সম্ভব হবে। ’
রিহ্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী সোহেল রানা বলেন, ‘পানি নিষ্কাশনের জন্য বিস্তীর্ণ জলাধার না রেখে মেকানিক্যাল ড্রেনেজ ডিজাইন করে বিদ্যমান পানি নিষ্কাশন সমস্যার সমাধানের চিন্তাভাবনা করতে হবে। তা হলে জনসংখ্যাবহুল বাংলাদেশের আবাসন শিল্পসহ ভূমির বহুমুখী ব্যবহার সহজতর হবে। উন্নত বিশ্বে পানি নিষ্কাশনের জন্য এত বিশাল আকারের খাল রাখা হয়নি। ’
পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-উন্নয়ন) মোজাম্মেল হক বলেন, ‘সিএস নকশা দেখে খাল উদ্ধারের চেষ্টা সফল হবে না। এতে লাখ লাখ মানুষ ভোগান্তিতে পড়বে। তাই ড্যাপের জন্য বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। সরকার যদি পুলিশের প্রকল্প থেকে খাল নিতে চায় তাহলে অধিগ্রহণ করে নেওয়া উচিত। শুধু কোনো একটি সংস্থা দাগ দিয়ে দিলেই সেখানে জলাশয় হয়ে যায় না। ’
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মফিজুল হক বলেন, ‘ঢাকায় অতিবৃষ্টি হওয়ার পর বৃষ্টির পানি জমে একাকার হয়ে যায়। কিছুদিন আগে বৃষ্টির পর ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় কমপক্ষে ৫০০ ছবি দেখাতে পারব, কোথায় কোথায় জলাবদ্ধতা হয়েছে। কিন্তু কত মাত্রার বৃষ্টি হলে কোন এলাকায় কী পরিমাণ পানি জমবে এমন কোনো সমীক্ষা সরকারি সংস্থার কাছে আছে বলে মনে হয় না। ’ রাজউক চেয়ারম্যানের আহ্বানে ডিএমপির এ কর্মকর্তা মাদানী এভিনিউ রাস্তাটি দখলমুক্ত করে দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করেন।
বিএলডিএর মহাসচিব মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন বলেন, ‘আমরা ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানে মতামত অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে কিছু সুপারিশ দিয়েছিলাম। এগুলো নতুন এ প্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত হলো কি না তা জানতে পারিনি। কাগজপত্র দেখে মনে হচ্ছে, সুপারিশগুলো খুব একটা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এ ছাড়া ড্যাপ পুনর্গঠন সংক্রান্ত মন্ত্রিসভায় যেসব বিষয় সংশোধন হয়েছে তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন করা হলে সেটা আমাদের প্রতি অন্যায় করা হবে। কারণ সরকারের সিনিয়র সাতজন মন্ত্রী ও ১৪ জন সচিবের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি যা সিদ্ধান্ত দিয়েছে তা মেনে নেওয়া উচিত। ’
মেজর জেনারেল আবু সাঈদ মো. মাসুদ বলেন, ‘পরিকল্পিত নগরায়ণে ড্যাপ আমাদের জন্য একটি দিকনির্দেশনা দেয়। তাই ড্যাপ অবশ্যই সবাইকে নিয়ে করতে হবে, যাতে সবার অংশগ্রহণে একটি সুন্দর পরিকল্পনা হয়। আজকে যে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তারা যেন সবার কথা শুনে আমলে নিয়ে সেটি তৈরি করে। বিপুল পরিমাণ অর্থ রাজধানীকে ঘিরে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। তাই পরিকল্পনার ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশনের একজন অভিজ্ঞ প্রতিনিধি রাখা উচিত। ’
রাজউক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, ‘আগের ড্যাপে কিছু ভুল-ত্রুটি রয়েছে, এটা সত্য। বাড়ির ভেতর রাস্তা আর রাস্তাকে বহুতল ভবন দেখানো হয়েছে। এবার এ ভুল করা যাবে না। এ জন্য সব কিছু ঠিকঠাক করে বাস্তবসম্মত করার চেষ্টা করছি। আশা করি, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সহযোগিতা নিয়ে ড্যাপের সমস্যার সমাধান করতে পারব। তবে আমরা এবারের ড্যাপে খাল, জলাধার এবং নদী রক্ষায় কোনো ধরনের ছাড় দেব না। ’
রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, একেকটি এলাকায় স্কুল-কলেজসহ সব সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান একই ছাতার নিচে থাকবে। এটাকে আমরা ব্লক উন্নয়ন নাম দিয়েছি। বাণিজ্যিক উন্নয়ন, রি-ডেভেলপিং জোনসহ পুরো পরিকল্পনাটি যেন আগামী শত বছরের জন্য বাস্তবসম্মত থাকে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
সূত্র: কালের কণ্ঠ