মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার কাটাখালী, হাতিমারা, টঙ্গিবাড়ি উপজেলার পাইকপাড়া, বেতকা, সিরাজদিখানের মালখানগর, লৌহজঙ্গের কাঠপট্টি এলাকায় গেলে মজার একটি দৃশ্য চোখে পড়বে। সেখানে গেলে দেখা যাবে কারুকার্যময় নতুন নতুন ঘর দাঁড়িয়ে আছে। নকশাখচিত এসব দোচালা, তিন চালা, চার চালা, সাত চালা ঘর তৈরি করা হয়েছে বিক্রি হবে বলে। সবাই বলে ঘরের হাট!
নকশা ভেদে ঘরের দাম দুই থেকে ১৫ লাখ পর্যন্ত
মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন জায়গায় এভাবেই নতুন ঘর তৈরি করে রাখা হয়। ক্রেতারা এসে পছন্দ অনুযায়ী ঘর কিনে নিয়ে যায়। একটি রেডিমেট ঘর বাড়িতে নিয়ে ‘সেট’ করতে তিন/চার দিন সময় লাগে। দুই থেকে ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি হয় এক একটি ঘর। ১৫ লাখ টাকায় তো রীতিমত একটা দালান তৈরি করা যায়! তাহলে টিনের ঘর কেন? এমন প্রশ্ন করতেই পাইকপাড়ার তৈরি ঘর ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল বলেন, ‘মূলত এই এলাকার মানুষের টিনের নকশা করা ঘরের প্রতি একটা আলাদা টান আছে। তাছাড়া, এই এলাকা নদী ভাঙন প্রবণ। তাই, দালানের পরিবর্তে টিনের ঘর অপেক্ষাকৃত বেশি পছন্দের। এটা পরে বিক্রিও করা যায়। একটি পুরাতন টিনের ঘর বিক্রি করলে দামও পাওয়া যায় ভাল।’
ব্যবসায়ী আব্দুল আউয়াল জানান, ‘৭ চালা আই-আঠাশ টপ বারিন্দা’ মানে সাড়ে ২৮ বর্গ হাত একটি ঘর যা জাপানি ‘অরজিনাল প্লেন শিট’ ও এক আইচ লোহা কাঠ দিয়ে তৈরি ঘর চার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকায় বিক্রি হয়। তবে দুই লাখ টাকায়ও খুব সুন্দর নকশা করা ঘর পাওয়া যাবে। আর পনের লাখ টাকায় ঘর বানাতে চাইলে আগে অর্ডার দিতে হবে। সেই ঘর সাইজে বড় হবে। পুরোটা হবে সূক্ষ নকশা করা লোহা কাঠের। ঘরের ভেতর থাকবে ‘কেবিন’।
১২ বছরের বেশি সময় ধরে ঘর তৈরির কাজ করা মিস্ত্রী সুধাংসু মণ্ডল, রাজন চন্দ্র মণ্ডল, সঞ্জিত মণ্ডল জানান, ২৩ বন্দের (মানে সাড়ে ৮ হাত বাই ১৫ হাত) একটি নকশা করা ঘর তৈরিতে ৯০ দিন সময় লাগে। সাধারণত তিনজন মিস্ত্রী মিলে এক মাসে একটি ঘর তৈরি করতে পারে। নকশা ও কাঠ ভেদে একটি ঘর দুই থেকে চার লাখ টাকায় বিক্রি হয়। তবে আমরা মিস্ত্রিরা পাই (পারিশ্রমিক) রোজ (দিন) হিসেবে। প্রতি রোজ ৬’শ টাকা, সঙ্গে খাবার। কেউ নিজে টিন, কাঠ কিনে বাড়িতে ঘর তৈরি করতে চাইলে আমরা মজুরি নিই ৩৫-৪০ হাজার টাকা।
ঘর বানাচ্ছেন কারিগররা
কাটাখালীর ঘরের হাটের ব্যবসায়ী সাজ্জাদ হোসেন জানান, আমরা কাঠ আনি চট্টগ্রাম থেকে। বাচালু, নাইজিরা, শাল, সেগুন, ওকান ও লোহা কাঠ দিয়ে ঘর বানানো হয়। ২৩ বন্দের ঘর বানাতে ১০৫ থেকে ১১০ কেবি কাঠের দরকার হয়।
তিনি বলেন, ‘বছরে প্রায় ২০-২২টি ঘর বেচা যায়।’
তবে বেতকার ঘর ব্যবসায়ী জালাল মোল্লা বলেন, ‘আগে যেমনটা জমজমাট ছিল এই ব্যবসা, এখন আর তেমন নেই। অনেক পুঁজি লাগে। গত পাঁচ বছরে শুধু জায়গার ভাড়াই দিছি এক লাখ ৭০ হাজার টাকা। কাঠের দাম, টিনের দাম সবই বেড়েছে। কিন্তু, সেই হারে ঘরের দাম বাড়ে নাই। আবার, এলাকার অর্থনীতি আলু নির্ভর। আর এই বছর বৃষ্টিতে আলুর অবস্থা খারাপ গেছে। গত তিন মাসে ঘর বিক্রি করছি মাত্র দুটা। অথচ বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ এই দুই মাস ঘর বিক্রির মৌসুম।’
ঘরের হাট
তবে, এই মৌসুমে বিক্রি যেমনই হোক, মুন্সীগঞ্জের মানুষের যে টিনের ঘরের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা তা যেকেউ ওই এলাকায় গেলেই বুঝতে পারবে। এলাকার ধনী, গরিব নির্বিশেষে প্রায় সবার বাড়িতেই দেখা মিলবে টিনের ঘরের। দোচালা, তিন চালা, চার চালা, সাত চালা এসব নকশা করা টিনের ঘরেই তারা বসবাস করছে বছরের পর বছর ধরে।