যান্ত্রিকতার ফাঁদে ক্রমেই আটকে পড়ছে ঢাকাবাসীর জীবন। হাঁপিয়ে ওঠা নগরজীবনে নেই সবুজের ছোঁয়া কিংবা নির্মল প্রকৃতি। এখানে বাতাসেও যেন বিষ। ইট-পাথরের ঘেরাটোপে নেই বুকভরা নিশ্বাস। তীব্র যানজট, ধুলোবালি, উচ্চ শব্দদূষণ আর মাত্রাতিরিক্ত জনঘনত্ব যেন এ শহরের অভিশাপ! তারপরও সব প্রতিকূলতা মাড়িয়ে এখানে জীবন ছুটে চলে প্রাত্যহিক নিয়মে। একই ধারায় চিরচেনা রূপে।
অথচ নগরী থেকে খানিক দূরে চোখ ফেরালেই চোখে পড়ে সবুজ আর স্বস্তির অন্য এক ভূখণ্ড। সেগুলোরই একটি রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ী এলাকা। যেখানে নাগরিক জীবনে একদণ্ড শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দিচ্ছে সবুজ বনানী। আছে শুভ্র কাশফুল, লেকের টলমলে জল, খোলা আকাশ আর বিশুদ্ধ বাতাস। একটু সুযোগ পেলেই ঢাকার মানুষ যেন আশপাশের এরকম স্থানগুলোতে ছুটে যেতে যান। পেতে চান প্রকৃতির সান্নিধ্য। এমনকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যারা কাজে কিংবা ঘুরতে ঢাকায় আসেন তারাও দুদণ্ড শান্তি খোঁজেন দিয়াবাড়ীর উন্মুক্ত আকাশের নিচে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, একসময় বিভিন্ন অপরাধীচক্রের দৌরাত্ম্যও ছিল দিয়াবাড়ীতে। ‘কিশোর গ্যাং’, ‘ফিটিং পার্টি’সহ বিভিন্ন সংঘবদ্ধ চক্রের হাতে নাজেহাল হওয়া, ছিনতাই বা ব্ল্যাকমেইলের কারণে টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোন খোয়ানো, মারধরের শিকার হওয়ার মতো ঘটনা ছিল সেখানকার নিত্যদিনের চিত্র। সেই দিয়াবাড়ীতেই এখন গড়ে উঠেছে ‘রাজউক উত্তরা এপার্টমেন্ট প্রকল্প’। প্রকল্পের ব্যয় ৯ হাজার ৩০ কোটি টাকা। গড়ে উঠেছে ৬ হাজার ৬৩৬টি ফ্ল্যাট।
কিন্তু অপরাধীচক্রের অভয়ারণ্য ও যাতায়াতের সুব্যবস্থা না থাকায় এখনো ৭০ শতাংশ ফ্ল্যাট খালি পড়ে আছে। বাকি ৩০ শতাংশ ফ্ল্যাটে মানুষের বসবাস আছে। সেখানকার বাসিন্দা ও ফ্ল্যাট মালিকেরা এখন স্বপ্নের মেট্রোরেলের পালকে ভর করে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন। কারণ, মেট্রোরেল উত্তরা মধ্য স্টেশন থেকে হেঁটে এ প্রকল্পে পৌঁছুতে সময় লাগে মাত্র ১০ মিনিট। ফ্ল্যাট মালিকরা বলছেন, মেট্রোরেল চালু হলে প্রকল্পের কোনো ফ্ল্যাটই ফাঁকা থাকবে না। যোগাযোগের ক্ষেত্রেও অনেকটাই স্বস্তি ফিরবে।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সাবেক উপ-পরিচালক হাজী মোহাম্মদ ইয়াছিন আলী। বর্তমানে রাজউক উত্তরা এপার্টমেন্টের কর্ণফুলি ভবনের একটি ফ্ল্যাটে ২০১৮ সাল থেকে বসবাস করেন। একসময় সেখান থেকে নিয়মিত মতিঝিলে অফিস করতেন। আবাসন থেকে আগারগাঁও এলাকা যেতেই কয়েক ঘণ্টা সময় লাগতো।
ইয়াছিন আলী জাগো নিউজকে বলেন, মেট্রোরেল আমাদের একমাত্র ভরসা। মেট্রোরেল না হলে এখান থেকে যাতায়াত করা সম্ভব নয়। যে কারণে ৭০ শতাংশ ফ্ল্যাট এখনো ফাঁকা। কারণ, সন্ধ্যা হলেই এই এলাকায় ভুতুড়ে পরিবেশ নেমে আসে। ছিনতাই ও চুরি প্রতিদিনের ঘটনা। একসময় আমরা সন্ধ্যার পর বাইরে যেতে পারতাম না। তবে মেট্রোরেল নির্মাণের পর ভয় কিছুটা কেটেছে। মেট্রোরেল চালু হলে আমরা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবো। সবাই মেট্রোরেলের দিকে তাকিয়ে আছি।
ওই প্রকল্পে বর্তমানে ১ হাজার ৬৫৪ বর্গফুটের তিন বেডের ফ্ল্যাট মাত্র ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকায় ভাড়া পাওয়া যায়। যাতায়াত সুবিধা না থাকা এবং দৈনন্দিন হাট-বাজারে অসুবিধার কারণে ভাড়াটিয়ারা এখনো প্রকল্পের দিকে ঝুকছেন না। আগামী ২৮ ডিসেম্বর নগরবাসীর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে স্বপ্নের মেট্রোরেল। সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, মেট্রোরেল চালুর মধ্য দিয়ে আবাসন প্রকল্পে আর ভুতুড়ে পরিবেশ থাকবে না। জৌলুস ফিরবে পুরো এলাকায়।
মূলত, যাতায়াত সুবিধা না থাকা ও নিরিবিলি পরিবেশই কাল হয়েছে আবাসনের বাসিন্দাদের। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অপরাধীচক্রের অনেকে কম ভাড়ায় সেখানকার বিভিন্ন ফ্ল্যাটে বসবাস করেন। মেট্রোরেল চালু হলে আবাসনে ব্যস্ততা যেমন বাড়বে ফ্ল্যাট মালিকেরাও দেখেশুনে পছন্দমতো ভালো ভাড়াটিয়া তুলতে পারবেন।
সেখানকার বাসিন্দা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাবেক কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ঢাকায় থেকেও আমরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। মেট্রোরেলের আশায় এখানে এসেছি। কিন্তু আবাসন এলাকায় ভুতুড়ে পরিবেশ। তবে মেট্রোরেল চালু হলে আমরা সব থেকে বেশি লাভবান হবো। কারণ, আমার ফ্ল্যাট থেকে মেট্রোরেলের স্টেশনের দূরত্ব পায়ে হেঁটে মাত্র ১০ মিনিট।
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের আবাসনের জন্য উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পে ফ্ল্যাট নির্মাণ করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। অনেকের ধারণা ছিল, সেখানকার ফ্ল্যাট হবে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। কিন্তু হয়েছে তার বিপরীত। নির্মাণাধীন এসব ফ্ল্যাট বরাদ্দে রাজউকের দেওয়া কঠিন শর্ত মেনে একটা ফ্ল্যাট পেতে কোটি টাকা গুণতে হবে। যা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের পক্ষে খুব কঠিন। তারপরও অনেক ফ্ল্যাট ফাঁকা। আর এই সুযোগে অনেক অপরাধী নাম-পরিচয় লুকিয়ে সেখানে নির্বিঘ্নে বসবাস করছেন।
কলাবতী ভবনের সভাপতি মোহাম্মদ নাসিরুজ্জামান বলেন, ভালো যাতায়াত ব্যবস্থা নেই। অনেক ফ্ল্যাট ফাঁকা। অপরাধীদের কেউ কেউ এই সুযোগ নিচ্ছেন। সম্প্রতি এক আদম কারবারিকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। বিদেশে লোক পাঠানোর নামে মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। এছাড়াও বিভিন্ন সময় অপরাধীচক্রের সদস্যদের এখান থেকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তবে আমার বিশ্বাস, মেট্রোরেল চালু হলে এসব ঘটনা থেকে মুক্তি পাবো।
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের আবাসনের জন্য উত্তরা তৃতীয় পর্ব প্রকল্পে ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছে রাজউক। রাজউকের উত্তরা তৃতীয় পর্বের ১৮ নম্বর সেক্টরে ২১৪ দশমিক ৪৪ একর জমির ওপর ফ্ল্যাট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। ‘এ, বি এবং সি’- এ তিন ব্লকে ফ্ল্যাট হবে ১৫ হাজার ৩৬টি। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৩০ কোটি ৭২ লাখ টাকা। প্রকল্পে ১৭৯টি ষোলতলা ভবন হবে। ‘এ’ ব্লকের কাজ শেষ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ‘বি’ ও ‘সি’ ব্লকের কাজ শুরুর কথা রয়েছে। ‘এ’ ব্লকের ৭৯টি ভবনে ৬ হাজার ৬৩৬টি ফ্ল্যাট প্রস্তুত করা হয়েছে।
রাজউক উত্তরা এপার্টমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ মোজাফফর উদ্দিন বলেন, মেট্রোরেলের পরিকল্পনা অনুযায়ী উত্তরা ১৮ নম্বর সেক্টরে আবাসন প্রকল্প নেওয়া হয়। আবাসনের বাসিন্দাদের মূল শহরে সংযোগ তৈরি করবে মেট্রোরেল। কারণ, আবাসন এলাকা থেকে পায়ে হেঁটে সহজেই রেল স্টেশনে যাতায়াত করা যাবে। ফ্ল্যাট বরাদ্দ শেষ পর্যায়ে, কিন্তু এখনো অনেক ফ্ল্যাট ফাঁকা। মেট্রোরেল চালু হলে ফ্ল্যাটগুলোতে দ্রুত বাসিন্দারা চলে আসবেন। তখন আর জনশূন্য নিরিবিলি পরিবেশ থাকবে না। মেট্রোরেল এ আবাসনের জন্য আশির্বাদ। জাগোনিউজ২৪