আমাদের মেইল করুন abasonbarta2016@gmail.com
আবাসন শিল্প ঘুরে দাঁড়ানোই চ্যালেঞ্জ

দেশের আবাসন ও সহযোগী শিল্পে ২০১৩ সালের পর থেকে বেশ কয়েক বছর চরম দুঃসময় গেছে। মাঝের একটি বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে সেই ভঙ্গুর অবস্থা থেকে একটু ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল শিল্পটি। ২০২০ সালে করোনার প্রথম ধাক্কা একেবারে বিপর্যস্ত করে দেয় আবাসন শিল্প খাতকে।

গত অর্থবছরের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগের পাশাপাশি ঋণের সুদ হার ও রেজিস্ট্রেশন ফি কিছুটা কমানোর কারণে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল আবাসন খাত। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় রীতিমতো মহা সংকটে পড়েছে দেশের আবাসন শিল্প খাত। অতীতে এই খাতের উদ্যোক্তারা কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি। এ সময় রড সিমেন্টসহ নির্মাণসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একইসঙ্গে আবাসন শিল্প সংশ্লিষ্ট ২১১টি ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ বা সহযোগী শিল্পখাত চরম হুমকিতে পড়েছে বলে জানিয়েছেন এসব খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা-পরবর্তী এই খাতে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান এখন ঘুরে দাঁড়ানোটাই বড় চ্যালেঞ্জ। 

মহামারি করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ধাক্কায় বর্তমানে একেবারেই স্থবির আবাসন খাত। ফলে ইট, বালু, রড, সিমেন্ট, কনস্ট্রাকশনের জিনিস, স্যানিটারি, সিরামিক, গ্লাস, অ্যালুমিনিয়াম, ক্যাবল ও লাইটিং শিল্পের মতো ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ খাতে নেমেছে বিপর্যয়। চরম ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তায় পড়েছে ৫৯ লাখ নির্মাণ শ্রমিকের কর্মসংস্থান। করোনার প্রকোপ কিছুটা কমার পরেও নতুন ভবন নির্মাণ পুরোপুরি বন্ধ রেখেছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। যেসব ফ্ল্যাট সম্পূর্ণ তৈরি সেগুলোর বিক্রিও প্রায় বন্ধ রয়েছে। 

আবাসন খাতের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এর সহ-সভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, করোনার সব কিছু ওলোটপালট করে দিয়েছে। এখনো সেই ধাক্কা সামাল দিতে পারছি না। গত দুই মাসে বাংলাদেশে কোনো ফ্ল্যাট বিক্রি হয়নি বললেই চলে। কিনে এখনই বসবাস করতে পারবে এমন অনেক ফ্ল্যাট সারাদেশে প্রস্তুত আছে। এসব ফ্ল্যাট প্রস্তুত করতে গিয়ে আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের পুঁজির বড় অংশ বিনিয়োগ করতে হয়েছে। ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে না, বিনিয়োগও ফেরত আসছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ এবং মন্দ থাকায় যেসব ক্রেতারা কিস্তিতে ফ্ল্যাট কিনেছিল তারাও এখন আর কিস্তি দিতে পারছে না। সংকট নিরসনে আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের টিকিয়ে রাখতে ব্যাংক ঋণের সুদ মওকুফ, স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ ও ব্যাংক ঋণ পরিশোধে সময় বাড়ানো উচিত। 

আবাসন শিল্প সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, আবাসন শিল্পের সহযোগী ২১১টি ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পের মধ্যে রয়েছে ২৭টি কনস্ট্রাকশনসামগ্রী খাত এবং ৪৩টি বাথ ও কিচেন ফিটিংস পণ্যসামগ্রী উৎপাদন ও সরবরাহকারী খাত। আরও রয়েছে ৪৪টি ইলেকট্রিক্যাল, ৪৪টি ফার্নিচার, ১৮টি সার্ফেস ফার্নিশিংসহ আরও অনেক ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্প। এসব খাতের মধ্যে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলছে দেশের সিমেন্ট, রড, স্টিল ও রি-রোলিং মিলস, সিরামিক ও টাইলস, কেমিক্যালস, ইট, বালু, পাথর, পিভিসি পাইপ, উড, গ্লাস, অ্যালুমিনিয়াম, কিচেন ফিটিংস, গ্যাস স্টোভ, ওয়াটার হিটার, আয়রন, ফ্লাশিং ইক্যুইপমেন্টস, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন, ট্রান্সফরমার, লাইট, কেবলস, ফ্যান, এয়ার কন্ডিশনার, এয়ারকুলার, বিল্ডিং ইনস্টলেশন, গ্লাস ডোর, টিমবার, ইলেকট্রিক্যাল সিকিউরিটি ডোর, বিল্ডিং সেফটি, মোজাইক, পেইন্ট, সিরামিকের বিভিন্ন পণ্য, বিভিন্ন ধরনের পাইপ, ফিটিংস, কাচ ও কাচজাতীয় অন্যান্য পণ্য, পাথর ও পাথরজাত পণ্য, পেইন্ট, লোহাজাতীয় বিভিন্ন পণ্য, আসবাবপত্র ও কাঠজাত বিভিন্ন পণ্য, প্লাইউড, বৈদ্যুতিক ফিটিংস ও অন্যান্য সামগ্রী, নির্মাণ কাজের যন্ত্রপাতি, আঠাজাতীয় বিভিন্ন পণ্য, স্টিলজাত পণ্য, অ্যালুমিনিয়াম খাতের মতো ২১১টি ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ বা সহযোগী শিল্প।

গত দেড় বছর ধরে আবাসন খাতে হুমকিতে পড়ায় বিপর্যয় নেমেছে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ শিল্পেও। এসব খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, আবাসন খাত সচল হলেই ঘুরে দাঁড়াবে লিঙ্কেজ শিল্প। এ ছাড়া আবাসন কোম্পানিগুলোতে ২০ হাজার নির্মাণকাজ ব্যবস্থাপক, ১০ হাজার ডিপ্লোমা প্রকৌশলী, তিন হাজার স্নাতক প্রকৌশলী এবং প্রায় ৫০০ স্থপতি নিয়োজিত রয়েছেন।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রির (বিএসিআই) সভাপতি প্রকৌশলী এস এম খোরশেদ আলম মনে করেন, আসলে প্রকৃতির ওপরে তো আমাদের কারও হাত নেই। গত দেড় বছর কনস্ট্রাকশন খাতের সব কাজ বন্ধ রয়েছে। এখনো আমরা সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারিনি। গুটি কয়েকজন ছাড়া মানুষের হাতে এখন টাকা নেই। এই শিল্প মাধ্যম আদৌও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি-না, বা কতদিন লাগবে ঘুরে দাঁড়াতে কোনো কিছু বলা যাচ্ছে না। 

আবাসন ব্যবসায়ীরা জানান, করোনার আগে শুরু করা তাদের নির্মাণাধীন ভবনগুলোর অধিকাংশের কাজ বন্ধ হয়ে আছে শুধু পাথর রড ও সিমেন্টের কারণে। আর আগে বুক দিয়ে রাখা ক্রেতাদের চাহিদার কারণে যাদের নির্মাণ কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে, তাদের পাথর, রড ও সিমেন্ট কিনতে হচ্ছে অনেক বেশি দাম দিয়ে। ফলে লোকসানের মুখে পড়েছেন বেশিরভাগ ব্যবসায়ী। দেশে যে পরিমাণে রড ও সিমেন্ট উৎপাদন হয়, তাতে চাহিদা না মেটায় আমদানি নির্ভর হতে হয় দেশের নির্মাণ শিল্পকে। তবে রড-সিমেন্টের কিছুটা যোগান দেশের উৎপাদনে পূরণ হলেও, বিশ্ববাজারে রডের কাঁচামালের দাম বাড়ায় গত দুই মাসে টন প্রতি রডের দাম বেড়েছে ১২-১৩ হাজার টাকা। তাতে বিপাকে পড়েছেন ব্যক্তি খাতে বাড়ি নির্মাণকারী, আবাসন ব্যবসায়ী ও সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদাররা। 

রডের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় সরকারের চলমান উন্নয়নকাজ তথা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে আবাসন শিল্প গভীর সংকটের মুখে। আবাসন খাতের বড় একটি অংশ ব্যয় হয় রডের পেছনে। সে জন্য রডের দাম বাড়লে এই শিল্পে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পরবে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আবাসন খাত। বাংলাদেশের আবাসন খাত অবশ্যই চাঙা করতে হবে। এর সঙ্গে বিশাল কর্মসংস্থান জড়িত। 

তার মতে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে প্লট ও ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেন খরচ অনেক বেশি। এটা কমিয়ে অর্ধেক করা খুবই জরুরি।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল) বলেন, যে কোনো ব্যবসা সচল রাখতে হলে অর্থনৈতিক লেনদেন থাকা লাগে। মানুষ যাতে ফ্ল্যাট-প্লট কিনতে পারে, তাই স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে গৃহ ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নিয়ে আসতে হবে। 

সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, এ ব্যবসা মানুষের জন্য বাসস্থান নির্মাণের মাধ্যমে দেশের আবাসন সমস্যার সমাধান যেমন করছে, তেমনি কর্মসংস্থানসহ উদ্যোক্তা সৃষ্টি করছে এবং লিংকেজ শিল্প বিকাশে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব ও ঝুঁকিমুক্ত অবকাঠামো বিনির্মাণ হচ্ছে এবং সরকারের রাজস্ব বাড়ছে; কিন্তু করোনার কারণে গত ৬-৭ মাসে আবাসন খাতে বিক্রির পরিমাণ ৬০ শতাংশের মতো কমে গেছে। উদ্যোক্তাদের নতুন প্রকল্প গ্রহণের হারও কমেছে ৭৫ শতাংশের মতো।